ভারতের জনজাতি: ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বর্তমান পরিস্থিতি (Tribes of India: History, Culture and Current Situation)
ভারত হলো এক বিশাল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ, যেখানে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির সহাবস্থান ঘটেছে সহস্রাব্দ ধরে। এই বহুবৈচিত্র্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল জনজাতি বা আদিবাসী সম্প্রদায়। “জনজাতি” শব্দটি দ্বারা বোঝায় এমন এক শ্রেণির মানুষ, যারা মূলত বন, পাহাড় বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে, যাদের নিজেদের আলাদা সংস্কৃতি, ভাষা ও সামাজিক ব্যবস্থা রয়েছে।
ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, কিছু নির্দিষ্ট (Tribes of India) জনগোষ্ঠীকে “তফসিলভুক্ত জনজাতি” (Scheduled Tribes – ST) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাদের জন্য রয়েছে বিশেষ অধিকার ও সংরক্ষণ নীতি। 2011 সালের জনগণনা অনুসারে, ভারতে মোট জনসংখ্যার প্রায় 8.6% হল জনজাতিভুক্ত, যা সংখ্যার দিক থেকে প্রায়10 কোটি 40 লক্ষের বেশি।

জনজাতিদের মধ্যে রয়েছে হাজারো ছোট-বড় গোষ্ঠী—যাদের মধ্যে কিছু বহুপ্রাচীন এবং কিছু সম্প্রতি সরকার কর্তৃক স্বীকৃত। যেমন সাঁওতাল, গোঁড, মিজো, নাগা, ভীল, মুণ্ডা, টোডা, ওরাওঁ ইত্যাদি।
তাদের জীবনধারা মূলধারার সমাজ থেকে অনেকটাই আলাদা। তারা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থেকে জীবনযাপন করে, এবং তাদের ধর্মবিশ্বাস, জীবনযাত্রা, উৎসব-পার্বণ, খাদ্যাভ্যাস সব কিছুতেই দেখা যায় এক অপূর্ব বৈচিত্র্য। অথচ, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তাদের অনেক সময় হয়রানির শিকার হতে হয়—ভূমি হরণ, পরিবেশগত বিপদ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব এসবই আজ তাদের বড় চ্যালেঞ্জ।
What is Bacteria? ব্যাকটেরিয়া কাকে বলে? বৈশিষ্ট্য, ব্যাকটেরিয়াকে উদ্ভিদ বলা হয় কেন?
ভারতের জনজাতির ইতিহাস (History of Indian Tribes)
জনজাতিদের ইতিহাস ভারতের ইতিহাসেরও প্রাচীনতর। সভ্যতার ঊষালগ্নে, যখন হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো গড়ে উঠছিল, তখনই ভারতের গভীর অরণ্যে, পাহাড়ি অঞ্চলে ও নদীর উপত্যকায় গড়ে উঠছিল আদিবাসী সংস্কৃতি। তারা ছিল প্রকৃতির সন্তান, জীবনের প্রতিটি দিকেই প্রকৃতির সঙ্গে এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আজকের (Tribes of India) জনজাতিরা সেই প্রাচীন ‘অস্ট্রিক’, ‘ড্রাবিড়’, ‘তিব্বতী-বর্মী’ জাতিগোষ্ঠীর উত্তরসূরি। তারা কৃষি, পশুপালন, শিকার এবং বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল ছিল। অনেক জনজাতির নিজস্ব শাসন ব্যবস্থা ছিল, এবং তারা নিজেদের মতো করে ধর্ম, শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল।
ভাষাগত দিক থেকেও জনজাতিদের রয়েছে এক বিশাল ঐতিহ্য। সাঁওতালি, গোঁডী, কুরুখ, হো, মিজো, নাগা ভাষাগুলি বহু পুরোনো এবং অনেক সময় মৌখিক রীতিতে চলে এসেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
ঔপনিবেশিক যুগে জনজাতিদের অবস্থা
ঔপনিবেশিক শাসনকালে জনজাতিদের জীবনে এক বড় ধাক্কা আসে। ব্রিটিশরা যখন ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর লোভী দৃষ্টি দেয়, তখন তাদের প্রথম লক্ষ্য হয় জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি। বন আইন, জমি অধিকার আইন প্রণয়ন করে তারা জনজাতিদের নিজভূমি থেকে সরিয়ে দেয়, শোষণ করে বনজ সম্পদ।
জনজাতিরা তখন নানা বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়—যেমন সাঁওতাল বিদ্রোহ (1855-56), বিরসা মুন্ডার উলগুলান আন্দোলন (1899), ভীল আন্দোলন প্রভৃতি। এ সব আন্দোলন ছিল শুধুই রাজনৈতিক নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার লড়াই।
ব্রিটিশদের ‘ম্যালিন টেকনিক’ অনুযায়ী জনজাতিদের ‘ব্যাকওয়ার্ড’ বা পশ্চাৎপদ বলে চিহ্নিত করা হয়, ফলে মূলধারার সমাজেও তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই মানসিকতা পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতে আরও অনেক সামাজিক বঞ্চনার উৎস হয়ে ওঠে।
General Knowledge Questions With Answers PDF in Bengali-সাধারণ জ্ঞান প্রশ্ন ও উত্তর PDF
ভারতের প্রধান প্রধান জনজাতি (Major Tribes of India)
সাঁওতাল
সাঁওতালরা ভারতের অন্যতম বৃহৎ জনজাতি, যাদের প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার ও ওডিশার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। এদের নিজস্ব ভাষা ‘সাঁওতালি’, যা ‘অলচিকি’ লিপিতে লেখা হয়। সাঁওতালদের সমাজ ব্যবস্থায় রয়েছে নিজস্ব পঞ্চায়েত, ধর্মীয় নেতা (নায়কে), এবং উৎসব যেমন ‘সোহরায়’ ও ‘বাহা’।
সাঁওতালদের একটি বড় পরিচিতি তাদের সাহসিকতা বিশেষ করে সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণে। আজও তারা কৃষি, বনজ ফল সংগ্রহ, পশুপালন ইত্যাদিকে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে ধরে রেখেছে।
গোঁড
গোঁড সম্প্রদায় ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, ওডিশা ও অন্ধ্রপ্রদেশে বেশি দেখা যায়। এরা ভাষাগতভাবে ‘গোঁডী’ ভাষায় কথা বলে এবং বেশিরভাগই কৃষিকাজে নিয়োজিত। গোঁডরা নিজেদের সমাজে এক উন্নত সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলেছে, যার মধ্যে রয়েছে ‘গোত্র’, ‘পঞ্চায়েত’ এবং লোকশিল্পে বিশেষ পারদর্শিতা।
তাদের ধর্মবিশ্বাস ‘গোন্ডি ধর্ম’ নামে পরিচিত, যেখানে প্রকৃতির উপাসনা করা হয়।
ভীল
ভীল জনজাতি পশ্চিম ভারতের রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্রে বেশি দেখা যায়। তারা একসময় ছিলেন দক্ষ শিকারি ও তীরন্দাজ। আজ তারা মূলত কৃষিকাজ ও ছোটখাটো শিল্পে জড়িত। ভীল সংস্কৃতিতে দেখা যায় প্রাণবন্ত নাচগান, যেমন ‘গাওরী নৃত্য’ এবং ‘ভীল নৃত্য’। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস মূলত হিন্দু ও লোকবিশ্বাসের মিশ্রণ।
টোডা, গারো ও অন্যান্য জনজাতি
দক্ষিণ ভারতে ‘টোডা’ জনজাতি ও উত্তরপূর্বে ‘গারো’, ‘নাগা’, ‘মিজো’ ইত্যাদি জনজাতিরা রয়েছে, যারা একে অপরের থেকে সাংস্কৃতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যেমন টোডারা নীলগিরির বাসিন্দা এবং পশুপালনেই তাদের প্রধান পেশা, অন্যদিকে গারোরা মূলত খাসি-জাঁতি সংক্রান্ত এবং খৃস্টান ধর্মে দীক্ষিত।
জনজাতিদের ভাষা ও সংস্কৃতি (Languages and cultures of indigenous peoples)
ভারতের জনজাতিদের মধ্যে ভাষার বৈচিত্র্য এতটাই বিশাল যে, অনেক সময় একেকটি জনজাতির মধ্যেই একাধিক উপভাষা থাকে। উদাহরণস্বরূপ, সাঁওতালি, মুণ্ডারি, ওরাওঁ, হো, কুরুখ, গারো, খাসি, মিজো, নাগা, টোডা প্রভৃতি ভাষা বিভিন্ন ভাষা পরিবার থেকে এসেছে।
এই ভাষাগুলি অনেক সময় মৌখিকভাবে প্রজন্মান্তরে প্রচলিত থেকেছে, পরে কিছু কিছু ভাষার নিজস্ব লিপিও তৈরি হয়েছে যেমন অলচিকি (সাঁওতালি)।
জীবনযাত্রা ও পেশা (Lifestyle and career)
ভারতের অধিকাংশ জনজাতিরা এমন অঞ্চলে বসবাস করে যেখানে আধুনিক নাগরিক সুবিধা পৌঁছায়নি বা অপ্রতুল। এসব অঞ্চলে প্রাকৃতিক পরিবেশই জীবনযাত্রার ভিত্তি। ফলে জনজাতিদের জীবিকা ও জীবনধারাও গড়ে উঠেছে এই পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।
তাদের প্রধান পেশা হলো কৃষিকাজ। যদিও এই কৃষিকাজ অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক পদ্ধতিতে হয় না। তারা প্রধানত ঝুম চাষ (slash-and-burn), পাহাড়ি চাষ ও স্বাভাবিক মৌসুমি চাষ করে থাকে। জলসেচ, সার, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে উৎপাদন অনেক সময় কম হয়, তবে তারা নিজেদের চাহিদা মেটাতে এই কৃষিকাজের উপর নির্ভর করে।
বনের সঙ্গে রয়েছে তাদের গভীর সম্পর্ক। বনের গাছ, ফল, শাকসবজি, মধু, গাছের ছাল, ওষুধি গাছপালা সংগ্রহ করে তারা স্থানীয় হাটে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেক সময় বনজ সম্পদ যেমন কাঁদা, বাঁশ, কাঠ ব্যবহার করে বাসনপত্র, মাদুর, ঝুড়ি বানিয়ে বিক্রি করে।
প্রকৃতির প্রতি এই নির্ভরতাই তাদের জীবনদর্শন গড়ে তুলেছে। তাই বন ও জমির অধিকার তাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শিক্ষা ও জনজাতির মধ্যে সাক্ষরতা (Education and literacy among the people)
জনজাতিদের শিক্ষা পরিস্থিতি বরাবরই দেশের গড় থেকে অনেক পিছিয়ে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী জনজাতিদের সাক্ষরতার হার ছিল প্রায় ৫৯% — যেখানে জাতীয় গড় ছিল প্রায় ৭৪%। এর পেছনে রয়েছে বহু কারণ।
প্রথমত, দূরবর্তী গ্রাম বা পাহাড়ি এলাকায় স্কুল গড়ে তোলা কঠিন, অনেক স্কুল থাকলেও শিক্ষক থাকেন না। যাতায়াতের অভাব, যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকা, শিক্ষা উপকরণের অভাব—সব মিলিয়ে শিশুদের স্কুলে পাঠানো কষ্টকর।
দ্বিতীয়ত, ভাষাগত বাধা অন্যতম কারণ। শিশুরা বাড়িতে স্থানীয় জনজাতীয় ভাষায় কথা বলে, কিন্তু স্কুলে পড়ানো হয় হিন্দি বা রাজ্যের সরকারি ভাষায়। ফলে তারা আগ্রহ হারায়, ঝরে পড়ে।
তৃতীয়ত, পরিবারের অর্থনৈতিক দুরবস্থা। অনেক শিশু কৃষিকাজ বা গৃহকর্মে জড়ায়, ফলে তাদের পড়াশোনার সময় ও সুযোগ থাকে না।
What is Virus? ভাইরাস কী? ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য, ভাইরাসের প্রকৃতি, ভাইরাসকে অকোষীয় বলা হয় কেন?
অর্থনৈতিক অবস্থা ও উন্নয়ন (Economic situation and development)
ভারতের অধিকাংশ জনজাতি পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। অর্থনৈতিকভাবে তারা এতটাই দুর্বল যে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসলহানি বা অসুস্থতাই তাদের আর্থিক পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এদের মধ্যে সরকারি বা বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশকারী সংখ্যা খুবই কম, যদিও সংরক্ষণ নীতির ফলে কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। বেশিরভাগ জনজাতি এখনো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে—দিনমজুরি, নির্মাণ শ্রমিক, খনির শ্রমিক ইত্যাদিতে কাজ করছে।
তাদের আয় অনিয়মিত, কাজের নিশ্চয়তা নেই, ফলে পরিবারে খাদ্যাভাব, চিকিৎসা সংকট, শিক্ষার অভাব চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।
আদিবাসীদের জন্য সরকারি প্রকল্প ও উন্নয়ন কর্মসূচি (Government projects and development programs for indigenous people)
সরকার জনজাতিদের উন্নয়নে বহু প্রকল্প চালু করেছে, যেমন:
- একলব্য বিদ্যালয়
- TRIFED (Tribal Cooperative Marketing Development Federation)
- আদিবাসী মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন
- ব্যাংক ঋণে ভর্তুকি
- আবাসন প্রকল্প (PMAY-G)
তবে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়নে রয়েছে অনেক বাধা—দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। প্রকল্পের তথ্য অনেক জনজাতি পরিবার জানেই না। স্থানীয় পঞ্চায়েত বা প্রশাসনের সাহায্য ছাড়া এসব সুবিধা পাওয়া কঠিন।
জনজাতিদের উন্নয়ন যদি সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে হয়, তবে স্থানীয় নেতৃত্ব, প্রকৃত জনগণের অংশগ্রহণ এবং সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে।
সামাজিক স্বীকৃতি ও সংগ্রাম (Social recognition and struggle)
জনজাতিদের এই বঞ্চনা থেকে মুক্ত করতে তারা নিজেরাই নানা আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। যেমন:
- সাঁওতাল বিদ্রোহ
- বিরসা মুন্ডার উলগুলান
- নাগাল্যান্ড, মিজোরাম আন্দোলন
- আধুনিক বনাধিকার আন্দোলন
এছাড়াও সামাজিক কর্মী, এনজিও, ছাত্র সংগঠন বিভিন্ন জায়গায় সচেতনতা বৃদ্ধি করছে। ধীরে ধীরে মূলধারার সমাজে জনজাতিদের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, কিন্তু পূর্ণ সমতা পেতে হলে আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
সংরক্ষণ নীতি ও সংবিধানিক অধিকার (Conservation Policy and Constitutional Rights)
সংরক্ষণের আইনি কাঠামো
ভারতের সংবিধান জনজাতিদের বিশেষ অধিকার ও সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছে। কারণ তারা বহু বছর ধরে আর্থ-সামাজিকভাবে বঞ্চিত ছিল। সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী, কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে জনজাতিদের জন্য বিশেষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
সংরক্ষণ নীতির মূল উপাদানগুলি হলো:
- শিক্ষা ক্ষেত্রে সংরক্ষণ: স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংরক্ষণ।
- চাকরিতে সংরক্ষণ: সরকারি চাকরি, UPSC/SSC ইত্যাদিতে ৭.৫% কোটা।
- রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব: লোকসভা ও বিধানসভায় সংরক্ষিত আসন।
- বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা: আদিবাসী ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত কোর্সে ভর্তির জন্য বৃত্তি।
সংশ্লিষ্ট সংবিধান অনুচ্ছেদ:
- 15(4): শিক্ষায় সংরক্ষণ
- 16(4): চাকরিতে সংরক্ষণ
- 338 ও 338A: ST কমিশনের গঠন
এই আইনি কাঠামোই জনজাতিদের সমাজে স্থান করে দিতে চায়, কিন্তু বাস্তবায়নের পথে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ।
তফসিলভুক্ত জনজাতি (Scheduled Tribes)
“Scheduled Tribes” হলো সরকার স্বীকৃত জনজাতির তালিকা, যারা সংবিধান অনুযায়ী বিশেষ সুবিধার অধিকারী। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কিছু নির্দিষ্ট মানদণ্ড রয়েছে যেমন:
- আলাদা জীবনধারা
- নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা
- নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক বাস
- আর্থ-সামাজিক পিছিয়ে পড়া অবস্থা
বর্তমানে প্রায় 705টি জনজাতি গোষ্ঠী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তফসিলভুক্ত। রাজ্য অনুযায়ী এই তালিকা ভিন্ন, যেমন পশ্চিমবঙ্গে 4টি, মধ্যপ্রদেশে 46টি, ওডিশায় 62টি ইত্যাদি।
তবে অনেক সময় দেখা যায়, যারা প্রকৃত জনজাতি নয় তারাও রাজনৈতিক কারণে তালিকাভুক্ত হয়ে সুবিধা নিচ্ছে, আবার অনেক প্রকৃত গোষ্ঠী আজও তালিকার বাইরে। ফলে প্রকৃত জনজাতিদের অধিকার রক্ষা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাংস্কৃতিক বিলুপ্তি (Cultural extinction)
আধুনিক সভ্যতা ও মিডিয়ার প্রভাবে অনেক জনজাতিরা তাদের নিজস্ব ভাষা, গান, নাচ, ধর্মবিশ্বাস ভুলতে বসেছে। তরুণ প্রজন্ম এখন শহরে গিয়ে চাকরি করছে, ফলে পরিবারভিত্তিক ঐতিহ্য টিকছে না।
অনেক জনজাতীয় ভাষা বিলুপ্তির মুখে। লোকনাট্য, রীতিনীতি, হস্তশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। এটি শুধু তাদের জন্য নয়, ভারতের জন্যও এক সাংস্কৃতিক ক্ষতি।
ভারতের জনজাতি সমাজ এই দেশের মাটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তারা প্রকৃতির সন্তান, ইতিহাসের ধারক, এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু যুগ যুগ ধরে তারা বঞ্চনার শিকার হয়ে এসেছে—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জমি, অর্থনীতি সব দিক থেকেই।
যদিও সংবিধান ও সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবুও বাস্তবায়নে রয়েছে প্রচুর ঘাটতি। আজ প্রয়োজন তাদের উন্নয়নকে শুধু দান বা করুণার চোখে না দেখে, অধিকার ও সম্মানের ভিত্তিতে এগিয়ে দেওয়া।
জনজাতিদের স্বর উঠে আসুক মূলধারায়, তাদের সংস্কৃতি বাঁচুক তাদের মত করে, আর ভারত হয়ে উঠুক এক সত্যিকারের বহুসংস্কৃতির, সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র।
0 Comments